হাদীসে কুদসী
من صحاح الأحاديث القدسية
যে সকল গ্রন্থে কেবল হাদীসে কুদসী সংকলিত হয়েছে, তন্মধ্যে সর্বাধিক প্রাচীন গ্রন্থ হিসেবে পরিচিত হচ্ছে আল্লামা মুনাভী (রহ.) প্রণীত আল-ইতহাফাতুস সানিয়া (الإتحافات السنية)। তিনি এতে মোট ২৭২টি হাদীস সংকলন করেছেন। তাঁর এ গ্রন্থের উপর আল্লামা মুনীর দামেশকী (রহ.) আন-নাফাহাতুস সালাফিয়্যা (النفحات السلفية) নামে একটি ব্যাখ্যাগ্রন্থ লিখেছেন।
ভারতবর্ষে, الإتحافات السنية في الأحاديث القدسية নামে একটি হাদীস সংকলন প্রকাশিত হয়, যার প্রণেতা হায়দারাবাদের মুহাম্মদ ইবনে মাহমুদ মাদানী হানাফী। তাঁর এ গ্রন্থে হাদীসের সংখ্যা ৮৬৪টি, যা পরবর্তীতে আরবদেশেও মুদ্রিত হয়।
শায়খ মুহাম্মদ রাগেব দুটি হাদীসে কুদসী সংকলন একত্রে প্রকাশ করেন—
১. মিশকাতুল আনোয়ার (مصباح الأنوار), মুহিউদ্দীন ইবনুল আরাবী (রহ.) কর্তৃক সংকলিত, এতে হাদীস রয়েছে ১০১টি।
২. মুল্লা আলী কারী (রহ.)-এর সংকলন, এতে হাদীস রয়েছে ৪০টি।
এই দুইটি মিলে মোট ১৪১টি হাদীস প্রকাশিত হয়েছে।
মিসরের আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয় একটি পরিষদ গঠন করে হাদীসে কুদসীর সংকলনের দায়িত্ব দেয়। তাদের সংকলনের নামও আল আহাদীসিল কুদসিয়্যা الأحاديث القدسية, যাতে ৪০০টি হাদীস অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে এতে হাদীসে কুদসীর সাথে হাদীসে নববীও অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা প্রয়োজনীয় ছিল না। এসব হাদীসে নববী বাদ দিলে মূল হাদীসে কুদসী একশ’র অধিক হবে না।
সউদির দুই প্রাজ্ঞ আলেম শায়খ মুহীউদ্দীন মাসউদ ও ড. মুহাম্মদ ঈদ খাতরাভী অত্যন্ত গবেষণার সাথে সংকলন করেন আল-মাকাসিদুস সানিয়্যাহ ফিল আহাদীসিল ইলাহিয়্যাহ (المقاصد السنية في الأحاديث الإلهية)।
উপমহাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ আলেমদের মধ্যে সাহেবানুল হিন্দ আহমদ সাঈদ অন্যতম। তিনি ‘খুদা কি বাতেঁ’ নামে একটি সংকলন রচনা করেন, যাতে কেবল উর্দু অনুবাদ রয়েছে, মূল আরবী হাদীস নেই। ফলে তা প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে গণ্য হয়নি।
উল্লেখযোগ্য যে, আল্লামা মুনাভী ও মুহাম্মদ ইবনে মাহমুদের সংকলনে হাদীসের সহীহ হওয়ার দিকটি বিবেচনা করা হয়নি। ফলে এসব সংকলনে দলিল হিসেবে অনুপযুক্ত অনেক বর্ণনাও স্থান পেয়েছে।
উল্লেখিত কিতাবগুলো সামনে রেখে শুধুমাত্র সহীহ ও হাসান হাদীসে কুদসী একত্র করে সংকলন করেছেন শায়খ মুহাম্মদ আওয়ামা (হাফিযাহুল্লাহ)। তাঁর গ্রন্থের নাম মিন সিহাহিল আহাদীসিল কুদসিয়্যাহ (من صحاح الأحاديث القدسية)। তিনি কেবল সেই হাদীসই সংকলন করেছেন—
১. যেগুলোর সনদ সহীহ বা হাসান।
২. দুর্বল বা দলিলযোগ্যতা না থাকা হাদীসগুলো বর্জন করেছেন।
৩. যেখানে স্পষ্টভাবে আল্লাহর বাণী বলা হয়েছে, কেবল সেই হাদীসই গ্রহণ করেছেন।
৪. যে হাদীসে আল্লাহর কথা প্রত্যক্ষভাবে উল্লেখ নেই, বরং ধারণা করা যায়— তাও সতর্কতার সাথে বর্জন করেছেন।
এভাবে তিনি ১০০টি বিশুদ্ধ ও সন্দেহাতীত হাদীস গ্রহণ করেন এবং সেগুলো বিষয়ভিত্তিকভাবে বিন্যস্ত করেন। এরপর সে হাদীসগুলোর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও তিনি করেছেন বিস্তারিতভাবে।
আমরা শায়খ মুহাম্মদ আওয়ামা (হাফিযাহুল্লাহ)-এর এই সংকলনকেই মূল অনুসরণীয় গ্রন্থ হিসেবে গ্রহণ করেছি। তিনি যেভাবে হাদীসগুলো বিন্যস্ত করেছেন, আমরাও সেভাবেই এখানে তা সংকলিত করেছি।
হাদীসে কুদসীর পরিচয়
'কুদস' শব্দের অর্থ: পবিত্র। আল্লাহ্ তা'আলা যাবতীয় দোষ ও ত্রুটি থেকে পবিত্র, তাই মহান আল্লাহর এক নাম 'কুদ্দুস' মহাপবিত্র। কতক হাদীসকে হাদীসে কুদসী বলা হয়। যেহেতু এ হাদীসগুলোর সম্পর্ক আল্লাহ্ তা'আলার সাথে। এ জন্য এ হাদীসগুলোকে হাদীসে ইলাহীও বলা হয়।
আল্লামা আলী কারী (রহ.) হাদীসে কুদসীর সংজ্ঞা বর্ণনা করে লিখেন:
হাদীস বর্ণনাকারীদের উৎস এবং আস্থাভাজন ব্যক্তিদের পূর্ণ চন্দ্র নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (তাঁর প্রতি আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে পরিপূর্ণ শান্তি ও সালাম বর্ষিত হোক) মহান আল্লাহ্ থেকে কখনো জিবরাঈল (আ.)-এর মাধ্যমে, কখনো অহী, ইলহাম বা স্বপ্নযোগে প্রাপ্ত ইঙ্গিত ও মর্ম নিজের পছন্দ অনুযায়ী শব্দ ও বাক্যের মাধ্যমে যা বর্ণনা করেন তাকে হাদীসে কুদসী বলে।
হাদীসে কুদসীর বর্ণনাকারীদের দুইটি ধারা পাওয়া যায়: এক. হাদীসের শুরুতেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: মহান আল্লাহ يَقُولُ اللهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى বা قَالَ اللهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى
দুই. হাদীসের মাঝে আল্লাহ তা'আলার বাণী বা নির্দেশ বা ঘোষণা বর্ণিত হয়েছে, সুস্পষ্টভাবে আল্লাহর কথা হিসাবেই। উভয় ধরনের হাদীসকেই হাদীসে কুদসী বলা হয়। যদিও প্রথম যুগের মুহাদ্দিসগণ কেবল প্রথম প্রকারটিকে হাদীসে কুদসী বলে উল্লেখ করেছেন।
কুরআন ও হাদীসে কুদসীতে পার্থক্য
১. কুরআন কালামে মু'জিয (অর্থাৎ মুজেযা), হাদীসে কুদসী কালামে মু'জিয হওয়া আবশ্যক নয়।
২. কুরআনের মর্ম ও ভাষা উভয় আল্লাহ্ তা'আলার নিজস্ব, হাদীসে কুদসীর মর্ম আল্লাহর, ভাষা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পক্ষ থেকে।
৩. কুরআন অবতরণে জিবরাঈল (আ.)-এর মধ্যস্থতা আবশ্যক। হাদীসে কুদসীতে তা আবশ্যক বা শর্ত নয়।
৪. কুরআন অস্বীকারকারীকে কাফের ও মুরতাদ গণ্য করা হয়। কিন্তু হাদীসে কুদসী অস্বীকার করা হলে তা কুফর বলা হবে না।
৫. কুরআন হচ্ছে মাতলু, অর্থাৎ, কুরআন পড়া না হলে নামায হবে না, হাদীসে কুদসী তেমন নয়; বরং নামাযে হাদীসে কুদসী পড়ার অনুমতি নেই।
৬. কুরআনের শব্দ ও ভাষা লাওহে মাহফুজে সুরক্ষিত রয়েছে, হাদীসে কুদসী এমন নয়।
৭. কুরআন তিলাওয়াতে প্রতিটি বর্ণে অন্যূন্য দশ নেকী, হাদীসে কুদসী পাঠে যদিও সওয়াব রয়েছে; কিন্তু কুরআনের তুল্য তা নয়, তার জন্য স্বতন্ত্র কোন ঘোষণাও করা হয়নি।
৮. কুরআন শরীফ স্পর্শ করতে পবিত্রতা শর্ত, যা হাদীসে কুদসীতে নয়, অবশ্য সম্মান ও মর্যাদা প্রকাশে হাদীসে কুদসী শুধু নয়; বরং দ্বীনী যে কোন পুস্তক পবিত্রতার সাথে ধরা ও পড়া বাঞ্ছনীয়। গোসল ফরজ থাকা অবস্থায় পড়া মোটেই কামন্য নয়।
হাদীসে কুদসী ও হাদীসে নববীর মাঝে পার্থক্য।
হাদীসে কুদসীর মর্ম মহান আল্লাহর, ভাষা নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের। হাদীসে নববী বা অন্য সকল হাদীস এরূপ নয়। যদিও আল্লাহ্ তা'আলা পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেছেন তিনি (নবী) যা কিছু বলেন তা ওহী, তাঁর নিকট ওহী পাঠানো হয়। কিন্তু উলামায়ে কেরাম বলেন, হাদীসের মর্ম ও ভাষা উভয়ই নবীজীর সাথে সম্পর্কিত। যদিও তা ওহী, তবে হাদীসে কুদসীর তুল্য নয়, কুরআনের তুল্য তো নয়ই। তাই হাদীসের বক্তব্য ঠিক রেখে শব্দে সামান্য পরিবর্তন করা বৈধ রয়েছে, সাহাবায়ে কেরাম নবীজির বক্তব্য সামান্য পরিবর্তনসহও বর্ণনা করেছেন এবং মুহাদ্দিসগণ তা যথাযথ বলে গ্রহণও করেছেন।